
প্রকাশিত: Thu, Jan 12, 2023 7:15 AM আপডেট: Sun, May 11, 2025 3:21 AM
পুঁজিবাদের ভেতরে বাস করে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কী করে লড়বেন?
আহসান হাবিব
[২] রাজনীতি এবং শিল্পের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা বাংলাদেশে প্রকট বলেই মনে হয়। শিল্প রাজনীতির বাইরের কোন বিষয় নয়, শুধু লড়াইয়ের ধরনটা আলাদা। একজন শিল্পী- সব ধরণের শিল্প মাধ্যমের- যে সংস্কৃতির মধ্য বাস করেন, তাকেই তার কাজে বাঙ্ময় করেন। কিন্তু তার কাজ কিভাবে করলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইটা করা হবে বলে মনে হবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিষয়টা সহজ। কারণ এখানে দুই প্রান্তিক শ্রেণী পরস্পর মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এক পক্ষ উৎপাদনের উপায়ের মালিক আর এক পক্ষ উৎপাদন শক্তি হিসেবে তার একমাত্র সম্বল শ্রমশক্তি বিক্রয় করে এবং সেজন্য সে মজুরি পায়, বেঁচে থাকে। রাজনীতি তাকে বুঝিয়ে দেয় এই দ্বন্দ্বের মিমাংসা একটাই- পুঁজিপতি শ্রেণিকে পরাজিত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলা। পুঁজিপতি যে তার উদ্বৃত্ত শ্রম আত্মসাৎ করে মুনাফা লুটছিল, বর্তমান ব্যবস্থায় তা আর সম্ভব হয় না। এখানে উৎপাদন এবং ভোগ দুটোই সামাজিক হয়ে ওঠে এবং দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তা বৈরমূলক নয়, অবৈরমূলক। বৈরমূলক দ্বন্দ্ব থাকে প্রকৃতির সংগে। সেই আলোচনা তোলা থাক ভবিষ্যতের জন্য।
পুঁজিবাদী বিকাশটা ঘটে যে পদ্ধতিতে, রাজনীতির সেই বিজ্ঞানটা জানতে হয়। দ্বন্দ্বের কোন স্তরে লড়াইয়ের সঠিক রণকৌশল এবং কর্মসূচি প্রণয়ন করে এগিয়ে যেতে হয়। আজ যে আমার শ্রেণী সহযোগী, আগামিকাল লড়াইয়ের স্বার্থে সে হয়ে উঠবে শ্রেণীশত্রু। তখন তার বিরুদ্ধে লড়াই হবে সঠিক রণকৌশল। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যদি হয় একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, সেই বিপ্লবে জাতীয়তাবাদী শক্তি সমাজতান্ত্রিক শক্তির সহযোগী। কিন্তু বিপ্লব শেষ হওয়ার সংগে সংগে জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই হয়ে উঠবে তার প্রধান কাজ। এই কাজটি বাংলাদেশে হয়নি। এই শক্তি বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি করেছে এবং পাতিবুর্জোয়া রোমান্টিকতা চর্চা করে গেছে। ফলে এই শক্তিটি বিলোপবাদেরে দিকে যাত্রা করেছে। এখন যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তারা প্রধানত দুই বুর্জোয়া দলের চুইয়ে পড়া খুদকুঁড়ো পাওয়ার কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে।
পাতিবুর্জোয়া রোমান্টিকতা কি? এটা আর কিছু নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অসংগতির বিরুদ্ধে এরা কথা বলে কিন্তু পুরাতন ব্যবস্থাকে আঁকড়ে থাকে। এরা পাতি মানে ক্ষুদে উৎপাদকদের স্বার্থের স্বপক্ষে একধরনের আবেগে ভোগে, ফলে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন মাঠে মারা যায়। এরা অতীতের জন্য স্মৃতিকাতর হয়। বাংলাদেশে বাম রাজনীতির দিকে যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে এই লক্ষণগুলি চোখে পড়ে। একটা সাধারণ উদাহরণ দিই: বাংলাদেশে যাতে কায়িক পরিশ্রমের যন্ত্র রিকশা, ঠেলাগাড়ি যাতে বহাল থাকে তার স্বপক্ষে মাঠে লড়াই করে, আবার এরাই মেট্রোরেলের বিরোধীতা করে নানা ছলে। চাইছে বিকশিত সমাজ, কিন্তু লড়াই করছে পুরনো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।
[৩] শিল্প সাহিত্যে এই লড়াই কি করে করবেন যখন আপনি একটি শোষণহীন সমাজ চাইছেন? অথচ সংস্কৃতি পুঁজিবাদী, সব শিল্প উপাদান এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হচ্ছে। রাজনীতিতে যেমন দুটি প্রান্তিক শ্রেণি সহাবস্থান করছে একই ছাদের নীচে, কিন্তু চেতনা পরস্পর বিরোধী, কিন্তু শিল্প সাহিত্যে সব উপাদানই পুঁজিবাদী, তাহলে এদের ব্যবহার এবং প্রকাশ কোন পদ্ধতিতে করলে বোঝা যাবে আপনি এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন? পরিবেশনের কৌশল আপনাকেই নির্মাণ করতে হবে। এটা খুব জটিল কাজ। নাটকে এই কাজটা অনেকেই করে দেখিয়েছেন, বিশেষত আমরা এক্ষেত্রে বের্টল্ট ব্রেখটের নাম করতে পারি। তিনি এপিক ধারার সৃজন করেছিলেন যেখানে মঞ্চ এবং দর্শক চিন্তার ক্ষেত্রে একই রেখায় অবস্থান করে। উভয়ই একই লক্ষ্যাভিসারী এবং ক্রিয়াশীল থাকে। এখানে কি হয়? পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে একমুখী চিন্তায় বুঁদ করে রাখে। সবকিছুকেই সে পণ্য বানায় এবং মানুষকে এই পণ্যে আসক্ত করে তোলে। ফলে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা ভুলে থাকে। শিল্পে কি করে এটা হয়?
[৪] কয়েকদিন আগে শিল্পকলায় একটা নাটক দেখলাম। লাইলী মজনু। এর পরিচালক যেভাবে এই নাটক উপস্থাপন করেছেন, তাতে দর্শক শুধু ঘটনার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছে কিন্তু পিতৃতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র বা নারী অধীনতা থেকে মুক্তির কোন দিশা পায়নি। বরং তারা ফিরে গেছে ধর্মীয় চিন্তার জগতে যেখান থেকে তারা প্রেমের ব্যর্থতা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। অর্থাৎ এই নাটকে মুক্তির কোন দিশা নাই। এটি ঐ সময়ের সামাজিক বাস্তবতা কিন্তু একজন শিল্পী শুধু তা এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেখানে দর্শক নিজে কোন নতুন চিন্তায় আক্রান্ত হচ্ছে না। ফলে এই শিল্প পিতৃতন্ত্রকেই বহাল রাখার পক্ষে কাজ করছে। শিল্পের কাজ সংস্কৃতির শিল্প রূপায়ন। পুঁজিবাদী লেখকরা শুধু ঘটনাকে আপনার সামনে তুলে ধরবে, কোন প্রশ্ন করবে না বা প্রশ্ন তোলার মত করে ভোক্তাকে উদ্দীপ্ত করবে না।
এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই যে শিল্পী সাহিত্যকরা সকলেই সাম্যবাদী চিন্তার পক্ষে কাজ করবে। লড়াইটা এখানেই। তারা তাদের শিল্প দিয়ে ভোক্তাকে বুঁদ করে রাখবে, একই শিল্প পুঁজিবাদবিরোধীরা ভোক্তাকে সেই ব্যবস্থাকে ভাঙতে সক্রিয়তা দেখাবে।
[৫] রাজনীতির মতই আমাদের দেশের শিল্পী সাহিত্যকরা রোমান্টিকতাবাদী। এরা চাইছে একটি শোষণহীন সমাজ কিন্তু কাজ করছে পাতিবুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষায়। এদের সাহিত্য এক ধরণের অতীত রোমন্থনকারক এবং ধর্মীয় নৈতিকতায় আচ্ছন্ন। এদের অভিমান আকাশছোঁয়া, এদের অভিযোগ বিস্তর। এদের সব দাবী বুর্জোয়াদের কাছে। বুর্জোয়ারা এদের কিছু দিলেই শান্ত থাকে যেমন রাজনীতিতে থাকে ক্ষমতার খুদকুঁড়ো খেয়ে। যদি সত্যি পুঁজিবাদী শিল্পের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান, কিভাবে পরিবেশন করলে ভোক্তারা লড়াইয়ের অংশী হয়ে উঠবে, তা বের করুন। অভিমান, অভিযোগ, গালাগালি কোন কাজের কাজ নয়। লেখক: ঔপন্যাসিক
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
